Alo Andhar by Aniruddha Bose
সীমা আর অসীম...
না, নায়ক নায়িকার নাম নয়। কবিতাও নয়, নিতান্তই কঠোর গদ্য।
সীমা কী? কীসের সীমা? জানার? না অজানার? না কি অন্য কিছুর? মানবমনের? না কি মানব-চেতনার? অসীমই বা কী? কবি বলেন এক, আর গণিতজ্ঞ বলেন আরেক। আর মাঝখানের যে সাধারণ মানুষ, তারা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না। তাদের কাছে সীমা হচ্ছে জানার সীমা। অসীম হচ্ছে জানার সীমানার বাইরের একটা রহস্যময় কিছু। চেতনার বাইরের একটা অবচেতন বা অতিচেতন স্তর।
সাধারণ পাঠক এতেই বিরক্ত হয়ে হাই তুলবেন। সীমা-অসীম, চেতন-অবচেতন-অতিচেতন এসব ইন্টেলেকচুয়াল তত্ত্বের কচকচানি শুনে কী লাভ? কিন্তু কেউ কেউ হয়ত স্রোতের বাইরে। মধ্যমেধার রাজত্বের বিবর্ণ ধুসর প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে একাকি হেটে চলা এই বিরল দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা ভাবেন এই সব নিয়ে। তাঁদের অনুসন্ধিৎসু চেতনার অস্পষ্ট ধ্যানালোকে ডাক আসে এক আশ্চর্য স্পন্দনে নিরন্তর স্পন্দিত হওয়া অতিচেতনের, শুষুম্না ঈড়া পিঙ্গলার দ্বার বেয়ে বয়ে চলা এক অবচেতন থেকে অতিচেতনে উত্তরনের আহ্বানের। জাগতিক দিকচক্রবালের নিঃঝুম আকাশগঙ্গায় স্নান করে ওঠা অস্পষ্ট মুক্ত আত্মার বিমূর্ত বর্ণহীন অবয়ব ভেসে যায় অসীমের দিকে। যাঁরা এই আহ্বানের মূক ভাষা বুঝতে পারেন, তাঁরাই সীমা আর অসীমের চিরন্তন দ্বন্দ্বের পরপারে চলে যাওয়ার পথটির সন্ধান পান। সন্ধান পান সীমা-অসীম ছাড়িয়ে সেই যে পরম অজ্ঞেয় ক্ষেত্র, সেই তূরীয়লোকের, আজ্ঞাচক্রের পথ ধরে সহস্রারের সেই পরমচেতনার অন্তিম আশ্রয়ে।
কিন্তু সেই ডাক শোনে কয় জনা? শুনতে পেলেও বোঝে ক’জন? বুঝলেও চেনাজানা সীমার নিরাপত্তার বাইরে পা বাড়াবার সাহস খুঁজে পায় ক’জন?
তবে কেউ কী পায় না?
না পায়। কেউ কেউ পায়। তারা বিরল। তারা ব্যতিক্রমী। তারা প্রায় সব সময়েই সমসাময়িকদের মাঝে একটা রহস্যময় চরিত্র, একটা এনিগমা। বা, পাগল!
এই রকম একটি চরিত্র অনিরুদ্ধ বসুর সাহসী সৃষ্টি ‘আলো আঁধার’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি। সে একটি মেয়ে। নাম? নামে কিছু যায় আসে কী? শ্যামা রমা বিশাখা দেবী বনলতা – নাম যাই হোক না কেন, সেটা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয় যেখানে মানবিক সঙ্কট প্রবল সেখানেই অস্তিত্বচিহ্ন গুরুত্বহীন। যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল তার চরিত্র। অতি সাধারণ চেনা জানা মেয়েটি জীবনের ঘটনাবহুল স্রোতে ভাসতে ভাসতে আর হাজারটা চরিত্রের মতো গড্ডালিকা প্রবাহে হারিয়ে গেল না, ভাগ্যের এক আশ্চর্য খেলায় সে হঠাৎই খুঁজে পেল জীবনের রহস্য সন্ধানের চাবিকাঠি। আলো আর আঁধারের চোখ ধাঁধানো খেলার মধ্য দিয়ে, হাজারটা চরিত্রের কাম ক্রোধ লোভ মোহ মদ মাৎসর্যের বেড়াজাল ভেঙে, নিজের সীমা পেরিয়ে সে পাড়ি দিল অসীমের খোঁজে। না কি তারও ওপারে? একদিন যে জ্ঞানের বিদ্যুতাগ্নি তার চেতনাকে শিখিয়েছিল ‘প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম’, যে জ্ঞানজ্যোতিঃ একদিন তার কাছে উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছিল তার অবচেতনের ঘুমভাঙানিয়া সঙ্গীত ‘অয়মাত্মানং ব্রহ্ম’, একদিন সেই জ্ঞানের আলোই তাকে বুঝতে শেখাল সীমা আর অসীমের আপাত বিভেদের অন্তস্থলে লুকিয়ে থাকা অভেধ সত্য ‘তৎত্বম অসি’। সেই জ্ঞানই অবশেষে তাকে নিয়ে গেল সীমা-অসীমের ওপারে এক একমেবাদ্বিতীম সত্যে – ‘অহম ব্রহ্মাস্মি’-র অতিচেতনে।
বইটির পাণ্ডুলিপি শেষ করার পর অনিরুদ্ধ বসুর এই অসাধারণ সৃষ্টিকে কী বলে সাধুবাদ জানাব ভেবে পাচ্ছিলাম না। বহুমাত্রিক এই উপন্যাসটি হয়ত সবাই একই দৃষ্টিতে দেখবেন না। সেটা সম্ভবও নয়, কাম্যও নয়। শুধু এই আশা করব, এই অপূর্ব কাহিনিটি কিছু সেরিব্রাল পাঠককে ভাবনার খোরাক যোগাক।
এমন একটি গণ্ডিভাঙা ব্যতিক্রমী উপন্যাস উপহার দেওয়ার জন্য লেখকের কাছে বাংলা উপন্যাস-সাহিত্য ঋণী থাকবে, যদিও এ আমার নিজস্ব অনুভূতি।
ধন্যবাদান্তে
আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়
দুর্গাপুর
Publications of Aniruddha Bose:
Reviews
A Quick Peep into ALO ANDHAR
Whatever cognised, groked, plumbed is finite. Beyond it, rest is infinite. Between the two exists an orphic realm. Most are twined in finite fetters seeking realisation, repose, amid its manacles. From crib to grave veiled by worldly illusive gossamer they seek the meaning of existence. Very few can gauge its volatility amid the crests and troughs of life. When they realise often it’s too late with scrimpy time left of reverting. Amid the finite, there is an illume aphotic grey zone. If one can feel it, one is able to taste infinite within finite realms. This Shangri-La is unique flavour of infinite in finite. The thirst to fathom this clandestine, anon world uplifts the mortal cognisance to fulfilment where transience, permanence fuses the sentience to universal vastness. ALO ANDHAR depicts the finite ‘Adhishthiti’ (Divine Union) of mortal ataraxis.
-by Purnasree Nag | 25-Aug-2017
আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষে বিনির্মাণের বেদনায় বিদীর্ণ মানবজীবনঃ
একুশ শতকে মানবসত্যের হালহাকিকত ও লেখকের স্বপ্ন
যে কোনও রচনার ‘রিভিউ’ কাজটি সর্বার্থেই অনভিপ্রেত। তার প্রধান কারণ সমালোচক প্রায়শই বিচারক হয়ে ওঠেন এবং লেখককে বুঝে উঠতে পারেন না বলেই নিজের বিদ্যা জাহির করে বসেন। বর্তমান সমালোচকও সে দূষণ থেকে যে মুক্ত হবে - তা বলা যায় না। তবু বইটি রিভিউ করার জন্য হাতে এসেছে।
‘আলো আঁধার’ লেখকের সদ্য প্রকাশিত অত্যন্ত সংবেদনশীল উপন্যাস। অসাধারণ দক্ষতায় বিভিন্ন চরিত্রায়নের ভেতর দিয়ে বর্তমান প্রজন্মের এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের জীবন যাপন প্রক্রিয়াকে তুলে ধরেছেন, যারা ভোগবৃত্তে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। অসীম স্বর্ণালী বিজিত বর্ণালী সুবিমল মৃত্তিকা সম্বিত সোহম সুব্রত সৌম্য দেবমাল্য মল্লিকা দেবলীনা প্রমীলা প্রতীক পূর্ণেন্দু মিঃ খাস্তগির অরুন্ধতী প্রদোষ শিখা রক্তিমা নীলোৎপল প্রমুখ চরিত্র স্ব স্ব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ভূমিকায় অনবদ্য। তাদের দিয়েই লেখক উপন্যাসটির বুনন প্রক্রিয়ায় কনজিউমারিজম দুনিয়ার ছবিটি সুস্পষ্ট করে মানবসত্যের ও মানবধর্মের পরিণতি কোথায় - তার একটি দিশা দিয়েছেন। আশাবাদী তিনি স্বপ্ন দেখেছেন - নৈরাশ্য নয়, সম্বোধি। চরম বাস্তবের ভেতর দিয়েই তা অর্জন করা দরকার। বিশাল জগদব্যাপী কর্পোরেট সাম্রাজ্য। তার কুশীলবদের খুশি রাখতে হয় - “ইটজ এ পার্ট অ্যান্ড অফ মডার্ন এক্সিজটেন্সস। এভ্রিথিং বয়েলস ডাউন টু ইকোয়েশনস। সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট। এটাই দুনিয়ার নিয়ম” মূল্যবোধের প্রশ্ন উঠলে এ প্রশ্নও উঠে আসে - “গিভেন দ্য চয়েস বিটুইন ভ্যালুস অ্যান্ড বিজনেস, হুইচ উড ইউ চুজ?” প্রশ্নটি নারীর পুরুষের কাছে। অত্যন্ত আধুনিক হলেও পুরুষের সাদামাটা উত্তর - “আই রেস্পেক্ট ট্র্যাডিশনাল ভ্যালুজ। ওনার দেম উইথ মাই লাইফ। দ্যাটজ অ্যাজ ফার অ্যাজ মি অ্যাজ এ পার্সন। মাই ওয়ে অফ লাইফ অ্যান্ড রিয়ারিং ফ্যামিলি। ব্যবসার ব্যাপারে আই গো উইথ দ্য টাইড। যে দেবতার যে পুজো। এনিথিং ইজ ফেয়ার টু গেট মাই মিনস”
এখানে মিনস অ্যান্ড এন্ড শব্দ দুটি প্রণিধানযোগ্য। এখানেই সারা বিশ্বজুড়ে মানুষের অন্তরলোকে দ্বিচারিতা চলেছে। ট্র্যাডিশনে ভ্যালুজ আজ বহু প্রশ্নের সম্মুখীন। এ প্রশ্ন উঠছে - মানুষ কেন ভোগবৃত্তের বাইরে আসবে? বিত্তবানের সমাজমুখিন না হলে কি বা এসে যায়? তার তো নিজস্ব বাঁচার জগত আছে।
সীমায়িত আয়ুর অধিকারী মানুষ কেন বৈরাগ্যের পথ ধরে ত্যাগীর জীবন উপলব্ধ করতে চাইবে? অপরদিকে এ-ও তো বাস্তব সত্য - মানুষ সর্বত্যাগী হতে চায়। সে ভোগবৃত্তের বাইরে অন্য কোনও উত্তরণের পথ খুঁজে চলে। যুগে যুগে সে পথেও তো মানুষের পদচারণা ঘটেছে, পদধ্বনি শোনা গেছে। পরীক্ষিত বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাই মানুষকে সে পথ দেখিয়েছে। এই উপন্যাসে লেখক সেই পথেই তাঁর কুশীলবদের টেনে এনেছেন।
মানবসত্তার প্রকাশে দু-টি ধারা সমান্তরালভাবে ব্যক্তিমানুষকে মহাজীবনে বা বিরাটমানবে উত্তরিত করেছে। সুস্পষ্ট দুটি ধারা - একটি প্রাচ্য অন্যটি পাশ্চাত্য। দুটি পথেরই শেষ কোথায় তা আজও অনির্ণেয়। লেখক বলেছেন প্রাচ্য পথই শ্রেষ্ঠ পথ - ভালোবাসার পথ, প্রেমের পথ, বৈরাগ্যের পথ ও অন্তরের পথ। সে পথে পা দিতে হলে আত্মনগ্নায়ন চাই, আত্মশুদ্ধি চাই, আত্মত্যাগ চাই। জীবন ক্ষেত্রটিকে সাধনাভূমি করে তুলতে না পারলে সে পথ লব্ধ হওয়ার নয়। প্রাচ্য ঋষি অরবিন্দ এই পথের পথিককে ‘Poetic Vision’-এর আধ্যাত্মিকতায় চৈতন্যময় দেখেছেন। পথিকের অগ্রগমনের প্রতি পদক্ষেপে এই ভিশনের রুপায়ন ঘটে চলে - “The poetic Vision of other things is not a criticism of life, not an intellectual or philosophic view of it, but a soul view, a seizing by the inner sense” এই পর্বেই মানুষ বৈশ্বিকবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সার্বরাষ্ট্রিক চেতনায় ঋদ্ধ সে বৃহত্তর সমাজগঠনের লক্ষে তখন আন্তর্জাতিক মানুষ। সে সবার সুখ চায়, সবাইকে ভদ্র হতে বলে, সকলের নিরাময় চায়। সে তখন সকল দেশের সকল মানুষের স্বজন - সে সবার। Jeremy Bentham (১৭৪৮- ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ) দার্শনিক Immanuel Kant (১৭২৪- ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দ) এই বিশ্বসমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এই বিশ্বমানবের কোনও নিজস্ব জাতিসত্তা নেই। সে তাঁর আত্মপরিচয় ভুলে ও সাদা কালো ধনী দরিদ্র ভুলে, সারা বিশ্বের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করে। প্রেম প্রীতি মৈত্রীতে পূর্ণ পৃথিবীর স্বপ্ন তাঁর মনে প্রাণে সকল কর্মে। রোমান কবি ভার্জিল (৭০- ১৯ খ্রিস্ট পূর্ব) এই শান্তিময় যুগের (Golden Age of Peace) স্বপ্ন দেখেছিলেন। Walt Whitman (১৮১৯ - ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর Years of Modern কবিতায় এই একই আশা ব্যক্ত করেছিলেন। Alfred Tennyson (১৮০৯ - ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর Locksley Hall (১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ) কবিতায় World Parliament সৃষ্টি বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেনঃ
“Till the war-drums throbbed no longer
And the battle flags were furled
In the Parliament of Man
And Federation of the World”
আলো আঁধার-এর লেখক এই পরম্পরা প্রতিভূ। তিনি এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের জীবন-যাত্রাকে এই উপন্যাসে তুলে ধরতে গিয়ে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন-যাত্রার বাস্তব সত্যের চেহারাটি তুলে ধরেছেন প্রাচ্য মানুষের অতীত জীবনসত্তার আলোকে। চরম বাস্তবই তো বস্তু সত্যের দৈননন্দিতার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ভাবসত্যের গভীরে পৌঁছে অবশেষে অন্তরসত্যে অবগাহন করে। এখানে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সাধনায় কোনও ফাঁক নেই। বৈরাগ্যের বেদনাও কম নয়, ভোগরে জীবনেও আছে ভয়ংকর পরিণাম। দু-দিক থেকেই মানুষ অভিজ্ঞতালব্ধ জীবনকে বুঝতে চাইছে। প্রাচীন প্রতীক ও জীর্ণ ঐতিহ্য যা শৃঙ্খলে পরিণত হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় পরিত্যাগ করার সাহস ও বিচক্ষনতা এখনও বিশ্বমানব দেখাতে পারেনি। এই উপন্যাসে লেখক তারও ইজ্জত করেছেন। যা শিলীভূত হয়ে গেছে তাঁর চর্চায় মগ্ন থেকে আপন সৃষ্টিশক্তিকে অমর্যাদা করার মানুষের একুশ শতকের পৃথিবীতে অভাব নেই। একথা সার্বিকভাবে সত্য, বাস্তবের মতো মানুষের অন্তরলোকেও অহরহ অন্যায় ন্যায়ের যুদ্ধ চলছে ‘যুদ্ধ জয়ের অর্থ ন্যায় ধর্মের জয় নয়, যুদ্ধ শুধু অন্যায় নয় অপরাধ। অন্যদিকে সংগ্রাম ছাড়া সত্যকে উপলব্ধ করা অসম্ভব। শান্তি সাধনা দ্বারা ত্যাগ দ্বারা, অর্জন করা সম্ভব’। লেখক বৈদিক মন্ত্র উদ্ধৃত করে পাঠককে তার অর্থ বোঝবার দিকে প্রাণিত করেছেন। শান্তি শব্দটি উচ্চারণ করতে হলে শব্দের অর্থ জানা দরকার কারণ শব্দ বুদ্ধিজাত, কর্ম মর্মজাত। শব্দ ও চিন্তা রক্তমাংসে পরিণত হওয়া চাই। আপন অন্তরলীন প্রকৃতিকে উপলব্ধি না করলে মানুষের সে অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। তার দ্বারা বুদ্ধিকে শাণিত করা যায় না, কর্মও মর্মজাত হতে পারে না। মানুষকে মর্ম দিয়ে জাগতিক প্রক্রিয়াগুলির দিকে নজর দিতে হয়। উপন্যাসের অসীম চরিত্রে এবং উপন্যাসের শেষ পর্বে বর্ণালী চরিত্রে তা ফুটে উঠেছে। শাশ্বত জীবনের অভীষ্ট এই জগত-ই দান করতে পারে। রোম্যান্টিক কবি P B Shelly (১৭৯২ - ১৮২২ খ্রিস্টাব্দ) Adnois কবিতায় তা স্পষ্ট করেছেনঃ
“The One remains, the many change and pass
Heaven’s light forever shines, earth’s shadow fly.
Life like a dome of many-coloured glass
Stains the white radiance of Eternity”
লেখক এই উপন্যাসে পরমেশ্বর এই পৃথিবীতে যে অলক্ষ্যে বিশ্ব বিধান সমগ্র সৃষ্টিকে সচল রেখেছে ও প্রতিপালন করে চলেছে তার দিকে তাকিয়ে মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দিয়েছেন শুধু নয়, মানুষ প্রতি মুহূর্তে এই বিস্ময়কে কারণ করে, আত্মস্থ করে, সৃষ্টির অংশ হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্বকে প্রতিষ্ঠিত করুক - সেদিকেও দৃষ্টিপাত করেছেন। এটা ঘটলেই তো বিশ্ববোধের জাগরণ ঘটে, বিশ্ব মানবিক সংগঠন গড়ে ওঠে। P B Shelly-র উক্তিতেই তা ধরা রয়েছেঃ
“For them, the common sense of most
Shall hold a fretful realm in awe
And the kindly earth shall slumber
Lopped in universal law”
এই উপন্যাসে লেখক যে মৌল ভাবনার আলোকে প্রাচ্য জীবনের বর্তমান সংকটগুলির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন, তা জগদব্যাপী মানবমনের বিস্ফোরণের দিক - এখানে প্রাচ্য পাশ্চাত্য একাকার হয়ে রয়েছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উৎপাদনের ভুবনায়ন থেকেই যে কর্পোরেট দুনিয়ার জন্ম, তাকে অস্বীকার করার অর্থ পিছিয়ে পড়া। এখন প্রাচ্য পাশ্চাত্যের জীবনযাত্রায় জাতিসত্তার কোনও বিশেষ স্থান নেই, যদিও দেশে দেশে এক শ্রেণির উগ্রবাদীদের আস্ফালন এ ব্যাপারে সীমাহীন। বোধিদীপ্ত মানব জীবনে প্রাচ্য পাশ্চাত্য বোধে কোনও ফারাক নেই। তাঁদের উপলব্ধিতে সব পথই শ্রেষ্ঠ পথ - যে পথ ভালোবাসার পথ, অন্তরের পথ। লেখক এই উপন্যাসে ভারতীয় জীবনকে তুলে ধরে বৈশ্বিক ভাবনার আলোকে, যে এগিয়ে চলার পথ নির্দেশ দিয়েছেন, বিখ্যাত দার্শনিক Roma Rola তার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন সেই কোন অতীতেঃ “…realize that the Cosmic Ego, wherein are barn the infinite modes of the Universe, is where thee; at every moment of the life, see and do good in the world” এটাই গৌতম বুদ্ধের অন্তিম সময়ের শেষ উচ্চারণ বাণী প্রিয় শিস্য আনন্দের কাছে ‘আত্মদীপো ভব, আত্মশরণো ভব, অনন্যশরণো ভব’ - নিজেকে প্রদীপ করে তোলো, সেই আলোয় পথ খুঁজে নাও, অন্যের শরণ নিও না। বুদ্ধদেবের বোধিসত্ত্ব লাভের পর প্রথম উচ্চারণ ‘মা হিংগী’ - হিংসা কোরো না। তার দেওয়া বহু শীলের মধ্যে, একটি শীল - ‘ন চ দিন্ন মা দিয়ে’ - যা তোমাকে দেওয়া হয়নি, তা তুমি নেবে না। ‘আলো আঁধার’ উপন্যাসে কর্পোরেট কর্তাদের জীবন-অভিজ্ঞানে এ-সব নৈতিক কৌলীন্যের স্থান নেই। ব্যবসায়িক ভোগবৃত্তের মধ্যে নারীকে পণ্য করে যে বৈষয়িক উত্থান তার শেষ কোথায়, তা পুরুষকে নয় নারীকেই খুঁজে নিতে হবে আপন শক্তিতে, যে শক্তি তার আছে, শুধু অদম্য উৎসাহ আর উদ্যোগ চাই। এ কাজে নারী যেন নারীর পাশে দাঁড়োয়, পুরুষ যেন সহমর্মী হয়। এই উপন্যাসের অন্তিমপর্বে অসীম বর্ণালীর সহযোগী হয়েছে। অপরদিকে নিজের বোন স্বামীকে ভুল বুঝে দিদিকে অহেতুক ধিক্কার জানিয়েছে।
উপন্যাসে অসীম ও মৃত্তিকা চরিত্র দুটি মহান উপলব্ধির এক বর্ণময় অংকন। আমৃত্যু বঞ্চিত মৃত্তিকা এইচ আই ভি পজিটিভ রোগাক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে, অথচ তার জীবনে যৌন সংসর্গের কোনও ঘটানাই ঘটেনি। এখানে চিকিৎসা জগতে কী পরিমাণ অবক্ষয় ঘটেছে তাও বিচার্য। অসীমের প্রতি মৃত্তিকার টান মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। উপন্যাস যত এগিয়েছে প্রতিটা চরিত্রই ততই নিড ও গ্রিড (Need and Greed) সস্পষ্ট হয়ে চরিত্রগুলিতকেও সুস্পষ্ট করেছে।
তবু প্রশ্ন থেকে যায় কোনও কোনও পাঠকের মনে। বর্তমান প্রাচ্য মানুষ কেন সামান্যার্থে অসুরশ্রেষ্ঠ বিরোচনের উত্তরাধিকারী। তারা কি এখন থেকে সাতাত্তর বছর আগে বর্ণিত রবীন্দ্রনাথের মহান্ত পুরুষের উত্তরাধিকারী? অবশ্যই নয়। কেন নয়?
“সেই পুরাতন কালে ইতিহাস যবে
সংবাদে ছিল না মুখরিত
নিজস্ব খ্যাতির যুগে -
আজিকার সেই মতো প্রাণযাত্রা কল্লোলিত প্রাতে
যারা যাত্রা করেছেন
মর্মর শঙ্কিল পথে
আত্মার অমৃত অন্ন করিবারে দান
দূরবাসী অনাত্মীয় জনে,
দলে দলে যারা
মরু বালুতলে অস্থি গিয়েছেন রেখে,
সমুদ্র যাদের চিহ্ন দিয়েছে মুছিয়া
অনারব্ধ কর্মপথে
অকৃতার্থ হন্ নাই তাঁরা -
মিশিয়া আছেন সেই দেহাতীত মহাপ্রাণ মাঝে
শক্তি যোগাইছে যারা অগোচরে চিরমানবেরে -
তাঁহাদের করুণার স্পর্শ লভিতেছি
আজি এই প্রভাত আলোকে -
তাঁহাদের করি নমস্কার”
(কালান্তর, ১২ ডিসেম্বর ১৯৪০ উদয়ন, শান্তিনিকেতন)
ঔপন্যাসিক এই একই বোধের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী হয়ে পথ অনির্ণেয় হলেও প্রাচ্য বাণীর পুনরুচ্চারণ করে বর্তমান প্রজন্মকে সম্বোধি যুক্ত হতে এগিয়ে দিয়েছেনঃ
“পৃথিবীর অন্তরিক্ষ দ্যুলোক, জলগুলি ওষধি সকল বনস্পতি সমূহ বিশ্বদেব সমূহ বিশ্বদেবের গান ও সকল দেবতা আমার শান্তিরূপ হোক। তাঁদের সকল শান্তির দ্বারা এ কর্মে যে ভয়ংকর ক্রূর ও পাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলির শান্তি হোক, মঙ্গলময় হোক, সবকিছু আমাদের শান্তিকর হোক” (অথর্ববেদ দশমসুক্ত ১৯ কাণ্ড ১ম অনুবাক)
এই প্রার্থনার ফলিত রূপ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা যেখানে আজও উচ্চারিত ‘যত্রবিশ্বভব্যতেক নীড়স’
প্রশ্ন উঠবে, সেই অতীত আজ কোথায়, কোন পরিণাম বহন করছে? লেখকের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কী ভাবে? Aristotle স্বপ্ন দেখতে নিষেধ করেছিলেন। তাঁর গুরুর গুরু সক্রেটিস রোমান যুবকদের জীবনের লক্ষই বিচার-বিবেচনার পথ ধরে বদলে দিয়েছিলেন। তার জন্যে তাঁকে হেমলক পান করে শাস্তি হিসেবে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল। স্ত্রী Xanthippe দুঃখ করেছিলেন “What a pity, you did not commit any wrong but had been forced to drink poison” । ক্রুদ্ধ সক্রেটিস উত্তরে স্ত্রীকে বলেছিলেন “Do you ask me to commit wrong and drink poison?” ছান্দগ্য উপনিষদের ৮ম অধ্যায়ে (৮/৭/৮) তৎকালীন ভারতবাসীকে বিরোচনের মতো সংগ্রামশীল হয়ে ওঠার পরামর্শ দিয়েছিলে, তাতে যদি অধঃপতিত ভারতবাসীর জাতিত্ব-বোধ একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। অতীতকে অবলম্বন করে চলার দিন শেষ হয়েছে। আজকের ভারতবর্ষের মানুষ দেহাত্মবাদী ভোগবাদী অসুর শ্রেষ্ঠ বিরোচনের মতোই। প্রজাপতির কাছে শিক্ষা সম্পূর্ণ না করেই বিরোচনের অসুর গানের কাছে ফিরে গিয়ে উপনিষদের অসম্পূর্ণ শিক্ষাই ব্যক্ত করে বলেছিলেন “এই পৃথিবীতে দেহরই পূজা করিবে ও দেহরই পরিচর্যা করিবে। দেহকে মহীয়ান করিলে এবং দেহের পরিচর্যা করিলেই ইহলোক পরলোক - এই উভয় লোকই লাভ করা যায়”
বর্তমান প্রজন্মও অন্তহীন পথে পা দিয়েছে প্রেয়কে পেয়ে, শ্রেয়কে লাভ করতে। তার জ্ঞান ভাণ্ডার তারই সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতা। ভারতের মানবসত্য কোন দিশা পাবে তা ভবিষ্যতই বলবে। Virgil তাঁর উত্তরাধিকারী প্রজন্মকেই দিয়েছিলেন সে বিচার করতেঃ
“The temporal and eternal fir, my son,
Thou hast beheld: thou art now come to a part
Whereof myself I see no further on.
I have brought thee hither both my wit and art.
Take for thy guide thine own hearts’ pleasure now
Forth from the narrows, from the steeps thou art”
ভার্জিল নিজের উপলব্ধিতেই শুধু বিশ্বস্ত থাকলেন না। প্রজন্মকে এগিয়ে যেতে বললেন সব কষ্ট ক্ষয় অবক্ষয় সহ্য করে। এই এগিয়ে যাওয়াই মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিব্যক্তি। এই এগিয়ে যাওয়ার অপ্রতিরোধ্য শক্তি তারই আছে - অন্য জীবের নেই। অগ্নিময় বিশ্বাস বুকে নিয়ে তার বৌদ্ধিক জাগরণ অহরহ ঘটে চলেছে। তার কোথাও থামা নেই।
চরৈবেতি চরৈবেতি।
লেখক এই উপন্যাসে সেই পথই দেখিয়েছেন। উপন্যাসটি কোনও অর্থেই বাজারি নয়। প্রচ্ছদ খুবই আকর্ষণীয় ও অর্থবহ। যে উপন্যাস বোধিদীপ্ত জীবনের বাণী বহন করে আনে সেখানে মুদ্রণ প্রমাদ, বানান ও উদ্ধৃতি ভুল না থাকাই অভিপ্রেত।
অমিয় বন্দ্যোপাধ্যায়
দক্ষিনি
১২/১০/২০১৭
-by Amiya Bandopadhyay | 12-Oct-2017
Alo Andhar Review Amiya Bandopadhayay
-by You Tube | 16-Oct-2017
Alo Andhar Promotion
-by You Tube