প্রথম প্রকাশের ভূমিকা
হার এবং জিত, এই দুই নিয়েই মত্ত আমরা সাধারণ মানুষেরা। চারদিকে তাকালেই দেখতে পাই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে। দু’দলের-ই একমাত্র উদ্দেশ্য জয়। হারতে কেউ চায় না। হারতে আমরা ভয় পাই। জিততে চাই সব কিছুতেই। আমাদের চোখে যে বিজয়ী সে হিরো, আর বিজিত, সে জিরো! এই হারজিতের মানসিকতা নিয়েই আমরা সর্বদা আমাদের জানাচেনা জগৎটাকে বিচার করি। কিন্তু ধু-ধু তেপান্তরের মাঠের মধ্যে যেমন হঠাৎ দেখা যায় এক-একটি বিরল তালগাছ... নির্মম রৌদ্র আর রাতের ঘোর অন্ধকারেও যার উন্নতশির উপস্থিতি দেখা যায়, অনুভব করা যায়, তেমনি সাধারণ জনসমুদ্রের সমতল আশা-আকাঙ্ক্ষার তেপান্তরের মধ্যে হঠাৎই চোখে পড়ে এক-আধজন বিরল মানুষকে, যারা হারজিতের বাইরে। যাদের সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিকে চেনা বড় দুষ্কর, কেননা আমাদের জানা চেনা জগতের কাছে, আমাদের জানা-চেনা মাপকাঠিতে তাদের মনে হয় অদ্ভুত। কোনও দলে ফেলতে না পেরে আমরা সেই বিরল ব্যক্তিত্বগুলিকে টেনে হিঁচড়ে নীচে নামানোর চেষ্টা করি। চেষ্টা করি আমাদের নিজস্ব প্যারাডাইমের বন্ধনে বেঁধে চেনা জানা মুখোশ পরিয়ে দিতে। কেননা, তাদের নিস্পৃহতাকে, তাদের হারজিৎকে সমান চোখে দেখার ক্ষমতাকে আমরা ভয় পাই। ভয় পাই তা আমাদের নিজস্ব অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে বলে।
কিন্তু তবুও তারা আছে, ছিল, থাকবে। সেই যারা এক উন্নততর জীবনদর্শনের খোঁজ পেয়েছে। যাদের কাছে সময়ের স্কেলটা অ-নে-ক বড় হয়ে গেছে। যারা আমাদের জানা চেনা হার-জিৎকে নিস্পৃহভাবে হঠিয়ে দিয়ে তার বাইরে এক বৃহত্তর জগতে তাকাতে শিখেছে।
যদি আপাত অবিশ্বাসকে দূরে সরিয়ে আমরা তাদের চিনতে চেষ্টা করি, তবে তাতে আমাদেরই লাভ। অনিরুদ্ধ বসুর এই উপন্যাসটির মাঝে এমন-ই একজন ব্যতিক্রমী মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়।
‘নিঃশব্দে’ উপন্যাসটি এক বিশাল ক্যানভাসে আঁকা একটি ছবি। আজকের অবক্ষয়ী অশান্ত দিকভ্রান্ত সমাজের এক নিঁখুত চিত্রায়ন। শল্যচিকিৎসক লেখক-রূপে হাতে কলম ধরেছেন বলেই হয়ত কলমকে শাণিত ছুরির মতো ব্যবহার করেছেন। আমাদের এই মধ্যমেধার রাজত্বের পচাগলা অংশগুলি শল্যচিকিৎসকের নিপুণ ভঙ্গিমায় ছেঁটে-কেটে ব্যবচ্ছেদ করে আমাদের অধিকাংশ মানুষের অর্থহীন বেঁচে থাকাটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে দ্বিধা করেননি। আর তার মধ্যেই অসীম মমতায় লেখক দেখাতে চেয়েছেন এক ‘অন্য’ মানুষকে, উপন্যাসের নায়ক দেবজিৎকে, যে আমাদের জানাচেনা চৌহদ্দির একদমই বাইরে।
সেই আশ্চর্য মানুষটি কিন্তু ঈশ্বর নয়, ঈশ্বর সাজার কোনও ইচ্ছেই তার নেই। রক্তমাংসের মানুষের সব কামনা-বাসনার মধ্যে থেকেও (উদাহরণ স্বরূপ নায়িকা বিদিশার, যদি তাকে নায়িকা বলা যায়, সঙ্গে এক তীব্র সংঘাতপূর্ণ অন্তরঙ্গ মুহূর্তে তার প্রতিক্রিয়া) সে অনন্য। লেখক এক চিরনতুন শ্লোকের মধ্যে দিয়ে তার মানসিকতাকে আশ্চর্যভাবে ধরেছেন। ‘তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জিতা মা গৃধ কস্য সিদ্ধনম’।
উপন্যাসটিতে হালকা কুয়াশার মতো মাঝে মাঝেই ভেসে এসেছে এক অদম্য কাম। এমনকী সাধারণের কাছে ট্যাবু লেসবিয়ানিজম্ এবং আজকের উচ্চবিত্ত সমাজের মধ্যে জনপ্রিয় সেক্সুয়াল অরগি-কে নির্মম নির্লিপ্ততায় বিশ্লেষণ করতে দ্বিধা করেননি অনিরুদ্ধ। এই বর্ণনা মাঝে মাঝে তথাকথিত অশ্লীলতার ধারে কাছে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতার প্যারাডাইমের শিকল ছিঁড়ে দু’চোখ খুলতে পারলেই, পাঠক বুঝতে পারবেন, এই কাম বা বিকৃত কাম, আসলে মানুষের অন্তরের অপূর্ণতা, জীবনে অনেক কিছু না-পাওয়ার হাহাকারেরই প্রকাশ মাত্র। এখানেই অনিরুদ্ধর সার্থকতা।
উপন্যাসটির কলেবর কিছুটা বড়, কিন্তু পড়তে বসলে অনায়াসেই একটানে পড়ে ফেলা যায়। আর শেষ হওয়ার পর বোঝা যায়, ‘নিঃশব্দে’ কখন যেন নিঃশব্দে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে। এক আশ্চর্য, প্রায় অবিশ্বাস্য মানুষের গল্প কখন যেন হয়ে উঠেছে পাঠকের নিজস্ব স্বপ্নের গল্প। বহু ঘটনার ঘনঘটা আর আপাত অশ্লীলতার মধ্যে এক অসাধারণ বক্তব্যের অনুরণন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো বাজতে থাকে ‘ওঁ পূর্ণমদ্য পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে, পূর্ণাস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবিশষ্যতে’
আজকের এই সংঘাতপূর্ণ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দোদুল্যমান খণ্ডিত সময়ে, এক পূর্ণতার আস্বাদ দেওয়ার জন্য অনিরুদ্ধকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
দুর্গাপুর, নভেম্বর ২০০৮ ডাঃ আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়
দ্বিতীয় প্রকাশের ভূমিকা
আমার প্রথম উপন্যাস ‘অন্বেষণ’-এর সাফল্যের পর, ‘নিঃশব্দে’ দ্বিতীয় উপন্যাস। বাস্তবধর্মী গণ্ডিভাঙা লেখা বলে বহু প্রকাশক প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে ২০০৮-এ প্রকাশ হওয়ার পর তুমুল সারা ফেলে। বারবার বেস্ট সেলারই শুধু হয়নি, লন্ডন বুক ফেয়ারে নতুন বাংলা চিন্তাধারা হিসেবে বিশেষ স্থান পায়। দিল্লির একটি নিরপেক্ষ সার্ভে রিপোর্টে (A Survey among visitors to the Kolkata Book Fair and exhibiting publishers, 2009) প্রশংসিত হয়।
রবীন্দ্রোত্তর যুগে হয়ত বাঙালি এতখানি নগ্ন সামাজিক চিত্রায়নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অকস্মাৎ এই লেখাটা পাঠককে এক নতুনত্ব দেয়। শুধু বিষয়বস্তু নয়, ভাষাশৈলীর দিক দিয়েও বাংলা সাহিত্যে এক ব্যাতিক্রমী সংযোজন। লেখায় বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, যার অনেকটাই সময়ের টানে সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে।
ম্যাচিওরিটির সঙ্গে লেখনীরও বিবর্তন হয়েছে। দ্বিতীয় প্রকাশে তার পরিমার্জন পাওয়া যাবে। এতে বিশেষ সহায়তা করেছেন অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। আমি তাঁর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ।
আশা করব প্রথম প্রকাশের মতো, দ্বিতীয় প্রকাশও জনপ্রিয় থাকবে কালস্রোতের ধারায়।
সল্ট লেক, আগস্ট ২০১৯ অনিরুদ্ধ বসু
Publications of Aniruddha Bose:
- Anweshan
- Dekha (Third Edition)
- Nishabde (Second Edition)
- Chakra (Second Edition)
- Tomake (Second Edition)
- The Vision
- Pursuit (Second Edition)
- Fulcrum
- Quest
- Canvase
- The Moment
- Sfulinga
- Canvas
- Eternal Mayhem
- Alo Andhar
- Conundrum
- Shadow
- Prohelika
- Complete Works of Aniruddha Bose (Volume 1)
- Complete Works of Aniruddha Bose (Volume 2)
- Complete Works of Aniruddha Bose (Volume 3)
- If...
|